মোঃ সারুয়ার সাদাত রুম্মান, রিয়াদ প্রতিনিধি।
রাত যত গভীর হয়, প্রবাসীর চোখ ততই ভিজে ওঠে। দেয়ালের ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলে, কিন্তু তার সময় থেমে থাকে দেশের এক কোণে—মায়ের অসুস্থ মুখ, বাবার নীরব দৃষ্টি, স্ত্রীর অভিমানী চোখ, আর সন্তানের ফেলে রাখা ছোট্ট জুতোজোড়া। হাজার হাজার মাইল দূরে বসে সে বারবার নিজেকে প্রশ্ন করে—“এই জীবনটা কি শুধুই টাকার জন্য?”
প্রবাসীর দিন শুরু হয় খুব ভোরে, কখনো হাড় কাঁপানো ঠান্ডায়, কখনো প্রচণ্ড গরমে। ক্লান্ত দেহ নিয়ে কাজে ছুটে যায় সে—নির্মাণ সাইটে, হোটেলে, কারখানায় কিংবা পরিচ্ছন্নতার কাজে। সারা দিন কানে বাজে যন্ত্রের শব্দ, হুকুমের সুর, কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত গালিগালাজ। তবুও সে সহ্য করে—পরিবারের মুখটা মনে রেখে।
সন্ধ্যা নামে, শহর ভরে ওঠে অচেনা মুখে, অজানা ভাষায়। অথচ তার মন থাকে নিঃসঙ্গতায় আচ্ছন্ন। ফোনে মায়ের কাঁপা গলা শোনে—“তুই খেয়েছিস রে বাবা?” সন্তানের প্রশ্নে—“আব্বু, তুমি কবে আসবে?”—তার চোখের কোণে জমে ওঠে জল। কিন্তু সে বলে—“খুব তাড়াতাড়ি, বাবা!”
তবে প্রবাসীর জীবনের আসল যুদ্ধ শুরু হয় রাতে। বাইরের নিস্তব্ধতার ভেতরে, তার মনজুড়ে চলে এক নিঃশব্দ ঝড়। খালি বিছানায় ঘুম আসে না—চোখ বন্ধ করলেই মনে পড়ে মায়ের ওষুধের খরচ, সন্তানের স্কুল ফি, স্ত্রীর না বলা কষ্ট। আর একসময় নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়ে এক ফোঁটা অশ্রু—যার সাক্ষী কেউ নয়।
মানুষ ভাবে, প্রবাসীরা বুঝি ডলার-পাউন্ডে ভাসে। তারা জানে না, এই মানুষগুলো কতটা না-পাওয়া বুকে নিয়ে বেঁচে থাকে। জীবনের সবচেয়ে সোনালি সময়টা তারা দিয়ে দেয় অচেনা মাটিকে, আর তাদের শিকড় পড়ে থাকে নিজের দেশে—অস্পর্শিত, অবহেলিত।
তবুও প্রবাসী বাঁচে—পরিবারের মুখে হাসি দেখার আশায়। হয়তো নিজের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিনগুলো নিঃশব্দে বিসর্জন দেয় অন্ধকারের গহীনে। কেউ না জানুক, প্রতিটি প্রবাসী জানে—এই পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ রাতগুলোর নাম নির্ঘুম প্রবাসজীবন।