আনোয়ার সাঈদ তিতু, কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি:-
কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার ছিনাই ইউনিয়নের বৈদ্যের বাজার এলাকায় ‘হিন্দুদের বাসায় ও মন্দিরে ভাঙচুর করার পরিকল্পনাকারী কিছু হিন্দু দুর্বৃত্তদের হাতেনাতে ধরা হয়েছে।’ শিরোনামে যে ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে, সেটির আসল ঘটনা জানার জন্য অনুসন্ধান করা হয়েছে।
ঘটনার সূত্রপাত গত ৮ আগস্ট রাতে হলেও তা ১১ আগস্টের পর থেকে দ্রুত ছড়াতে থাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ঘটনার অনুসন্ধানে গিয়ে ঐ ঘটনার বাস্তবতার সাথে ভিডিওর ক্যাপশনে উল্লেখ করা ঘটনার মিল পাওয়া যায়নি। একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ থেকে গুজব ছড়ানোর পর সেটা নিয়ে বিচার ও পরবর্তীতে গুজব কিভাবে মোকাবিলা করা যায় এজন্য হিন্দু-মুসলমান একত্র হয়ে সেই বিষয়ে আলোচনা হয়েছিলো। ঐ বৈঠকে গুজব প্রকাশের জন্য ক্ষমা চাওয়া হয় উপস্থিত লোকজনের কাছে। অন্যদিকে সেই সময়ে উপস্থিত থাকা একজন ফেসবুকে লাইভ করে বিভ্রান্তিকর ক্যাপশন ও বর্ণনা দেন। পোস্ট করা ভিডিওটি ইতোমধ্যে প্রায় ১০ লাখ মানুষের কাছে পোঁছে গেছে।
ঘটনা যেভাবে শুরুঃ
৫ আগস্ট সরকার পতনের পর সারাদেশে শুরু হয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাড়িতে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ। হিন্দু আ.লীগ নেতাকর্মীদের বাড়িও এই হামলা থেকে রক্ষা পায়নি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই খবর গুলো ছড়িয়ে পড়লে পুলিশ শূন্য বাংলাদেশে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকেন সাধারণ হিন্দুরা। সেই নিরাপত্তাহীনতার ভাবনা থেকে প্রতিবেশী হিন্দু পরিবারগুলোর সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খোলার সিদ্ধান্ত নেন রাজারহাট উপজেলার ছিনাই ইউনিয়নের বৈদ্যের বাজার গ্রামের যুবকেরা। ঐ গ্রামের যুবক সুজিত কুমার রায় ৮ আগস্ট রাত ১১টা ১৮ মিনিটে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ তৈরি করেন। গ্রুপটির নাম ছিলো ‘বৈদ্যের বাজার হিন্দু ঐক্যজোট’। গ্রুপটি খোলার পর একে একে ঐ গ্রামের মোট ৬৮ জন হিন্দু ধর্মালম্বী যুক্ত হন। তারপর রাত সাড়ে ১১টার দিকে গ্রামের যুবক শিখর রায় তার প্রতিবেশী সন্তোষ ভেন্ডার ও চপল ভেন্ডারের বাড়িতে হামলার সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেন।
‘বৈদ্যের বাজার হিন্দু ঐক্যজোট’ নামে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ
ভাইরাল হওয়া বৈঠকের ভিডিওতে শিখরকে সেই ঘটনার ব্যাপারে বক্তব্য দিতে দেখা যায়। সেখানে তিনি বলেন, ‘৮ আগস্ট রাতে আমার কাছে অপরিচিত একটি নম্বর থেকে ফোন আসে। আমাকে বলা হয় আমার প্রতিবেশী দুই মামার বাড়িতে আজ রাতে হামলা হবে। সেটা আমি ঐ হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে উল্লেখ করি। অপরিচিত ঐ ব্যক্তি আমাকে তার পরিচয় দেয়নি।’
সেই তথ্য কিছুক্ষণের মধ্যে ছিনাই ইউনিয়নের যুবদলের সদস্য সচীব পলাশ বসুনিয়ার কাছে পৌঁছালে তিনি বিষয়টির তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে আরও কয়েকজনকে জানিয়ে সেই দুই বাড়িতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। এই তথ্যটি গ্রামে ছড়িয়ে পড়লে আতঙ্ক শুরু হয় এলাকায়। রাত জেগে ঐ এলাকা পাহারা দিতে থাকেন বিএনপি, জামাতের নেতাকর্মীরা। এরই মাঝে ঐ গ্রামের একাধিক ব্যক্তি পলাশ বসুনিয়াকে ফোন দিয়ে আরও কয়েকটি বাড়ির হামলার আশঙ্কার কথা জানালে তাৎক্ষণিকভাবে সেই স্থানের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন তিনি।
হামলার ষড়যন্ত্র ও গুজব সৃষ্টিকারী হিসেবে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে থাকা ৬৮ জন ব্যক্তির একটি তালিকা হাতে এসেছে। একাধিক ফেসবুক পোস্টে ওই গ্রুপে থাকা ৬৮ জনকে হামলার পরিকল্পনাকারী ও গুজব সৃষ্টিকারী হিসেবে দাবি করা হয়। যে দুই ব্যক্তির বাড়িতে হামলার আশঙ্কা নিয়ে গ্রুপে ম্যাসেজ দেয়া হয়েছিলো, তাদের একজন (সন্তোষ ভ্যান্ডার) ওই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত আছেন।
গুজব সৃষ্টি নিয়ে যা ঘটলোঃ
পরবর্তীতে হামলার আশঙ্কার বিষটি গুজব প্রমাণিত হলে পরদিন (৯ আগস্ট) বিকেলে স্থানীয় বিএনপি নেতা পলাশের নেতৃত্বে হিন্দু সমাজের ব্যক্তিবর্গকে সাথে নিয়ে বাজারে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় বৈদ্যের বাজারের পলাশ বসুনিয়ার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। সেই বৈঠকে গুজব ছড়ানোর জন্য ক্ষমা চান শিখর রায়। পরবর্তীতে গুজব যাতে না ছড়ানো হয় এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন থাকতে বলেন পলাশ বসুনিয়া। গ্রুপে এমন বিভ্রান্তিকর তথ্য আরও ছড়ানোর আশঙ্কায় গ্রুপটি কিছুক্ষণের মধ্যে ডিলিট করে দেন সুজিত কুমার রায়। বৈঠকে বিএনপির নেতাকর্মীদের পাশাপাশি জামাতের নেতাকর্মীরাও উপস্থিত ছিলেন। যে কোনো সংকটের সময় হিন্দুদের পাশে থাকার অঙ্গীকার জানান বিএনপি, জামাতের নেতাকর্মীরা।
সরেজমিনে যা জানা গেলোঃ
১৩ আগস্ট (মঙ্গলবার) সরেজমিনে গিয়ে ঐ বৈঠকে উপস্থিত কয়েকজনের সাথে কথা বলা হয়েছে। বৈঠকের সময় ফেসবুক লাইভ করা ভিডিওটির শিরোনাম ও ভয়েস ওভারের সাথে বাস্তব ঘটনার মিল নেই বলে মনে করছেন বৈঠকে উপস্থিত লোকজন। ঐ সময় যারা গত (৮ আগস্ট) গুজব ছড়িয়েছিলেন তাদের বিচার ও পরবর্তীতে যাতে গুজব না ছড়ায় এমন আলোচনায় ব্যস্ত থাকায় সেই লাইভটির দিকে মনোযোগ দেননি কেউ।
ঐ বৈঠকে উপস্থিত থেকে ঘটনাটি ফেসবুকে লাইভ করেন কেএম মামুন অর রশিদ নামে এক যুবক। তার ক্যাপশনে ভাঙচুর করার পরিকল্পনাকারী হিসেবে গুজব সৃষ্টিকারীদের উল্লেখ করা হয়েছে। মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয় তার সাথে। গুজব সৃষ্টির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা মন্দির ও বাড়ি ভাঙচুর করার পরিকল্পনাকারী হিসেবে উল্লেখ করার কারণ জানতে চাওয়া হয় তার কাছে। সেই প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি। এই প্রশ্নের পর তিনি কিছুক্ষণ চুপ থাকার পরেও এ ব্যাপারে কোন উত্তর দেননি।
কোথাও কোথাও একই ঘটনাটি ‘ হিন্দু বাড়িতে ও মন্দিরে হামলা করতে গিয়ে ১০ জন হিন্দু হাতেনাতে আটক’ শিরোনামে ফেসবুক স্ট্যাটাস ছড়িয়ে পড়ছে, যার সাথে বাস্তবতার মিল পায়নি প্রতিবেদক। ভাইরাল হওয়া এই পোস্টের সাথে তার এর কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে দাবি করেন কেএম মামুন অর রশিদ। পাশাপাশি ঐ এলাকার কোনো বাড়িতে ও মন্দিরে হামলার ঘটনাই ঘটেনি।
এ ব্যাপারে যুবদল নেতা পলাশ বসুনিয়া বলেন, ঐ ভিডিওর ক্যাপশনে মিমাংসার বিষয়টিও উল্লেখ করা প্রয়োজন ছিলো। এছাড়াও ঘটনাটির বিস্তারিত জানতে ৩৪ মিনিটের পুরো ভিডিওটি দেখার পরামর্শ দেন তিনি। তিনি আরও বলেন, গুজব সৃষ্টি করে আতঙ্ক তৈরি করার ষড়যন্ত্র ছিলো। আমরা দ্রুত এটা আটকে দেই। কিন্তু মন্দির ও হিন্দু বাড়িতে হামলা করতে গিয়ে কেউ আটক হয়নি। এই বিষয়টিও গুজব।
যেভাবে গুজবের সৃষ্টি:
বৈঠকে উপস্থিত হয়ে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে হামলার আশঙ্কার কথা উল্লেখকারী শিখর রায় যে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, সেই বক্তব্যের সাথে ১৩ আগস্ট দেয়া বক্তব্যের মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। প্রথমে তার কাছে বৈঠকে দাবি করা অপরিচিত নম্বরটি চাওয়া হলে তিনি সেটি দেননি। কিছুক্ষণ পর একই গ্রামের আরেক যুবক আনন্দ রায়কে নিয়ে এসে দাবি করেন, তিনি এই বিষয়টি আনন্দ রায়ের কাছে শুনেছেন। আনন্দ রায়কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, আমার প্রতিবেশী সন্তোষ রায়ের সাথে ৮ আগস্ট রাতে দেখা হলে তিনি আমাকে দেশের পরিস্থিতি বিবেচনায় সতর্ক থাকতে বলেন। এবং একটি বাড়িতে হামলা হতে পারে বলে আশঙ্কার কথা প্রকাশ করেন তিনি। এরপর সন্তোষ রায়কে খুঁজে বের করা হয়।
সন্তোষ রায় বলেন, আমি কাউকে কারও বাড়িতে হামলা হতে পারে এমন তথ্য দেইনি৷ বরং আনন্দ’র সাথে আমার দেখা হলে রাতে সবাইকে সতর্ক থাকতে বলি। ঐ হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ছাড়াও একে অপরের সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগ করে এলাকায় হামলার ব্যপারে সতর্ক থাকার আলোচনাও করেছিলেন অনেকে।
হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপটি খোলার পর দ্রুত ডিলেটও করেন সুজিত কুমার রায়। তিনি বলেন, এই সময়ে আমাদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য গ্রুপটি খোলা হয়। অপরিচিত কেউ যেন যুক্ত হতে না পারে এজন্য যুক্ত সবাইকে পরিচয় দিতে বলছিলাম। সেই সময় শিখর রায় তার প্রতিবেশী হিন্দু বাড়িতে হামলা হতে পারে বলে জানায়। উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া এসব কথা না বলার জন্য তাকে আমি সতর্ক করি। নিজেদের মধ্যে এসব আলোচনার মধ্যেই স্থানীয় বিএনপি নেতার কাছে পৌঁছে যায়। তারপর তিনি আমাদের নিরাপত্তার জন্য তৎপর হন। জানাজানি হলে আমাকে এই বিষয়টি নিয়ে অনেকে ফোন দিয়ে বিস্তারিত জানতে চান। আরও গুজব ছড়ানোর আশঙ্কায় আমি দ্রুত গ্রুপটি ডিলেট করি। আমাদের গ্রামে কোনো হিন্দু বাড়ি ও মন্দিরে হামলা হয়নি। এখানে আমরা হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশে ভালোই আছি। এগুলোতে হামলার পরিকল্পনাও কেউ করেনি।
বিষয়টি নিয়ে প্রথম দিন থেকেই খোঁজখবর নিচ্ছিলেন রাজারহাট উপজেলার রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক খন্দকার আরিফ। তিনি বলেন, গুজব সৃষ্টিকারী এই গ্রুপটির কর্মকাণ্ড সন্দেহজনক। দেশবিরোধী কোনো চক্রান্তে এদের সংযোগ আছে কিনা এ ব্যাপারটা আরও খতিয়ে দেখা দরকার।’
কুড়িগ্রামের পুলিশ সুপার আল আসাদ মো. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি আমরা গভীরভাবে খতিয়ে দেখবো। কেউ ঘটনা না ঘটার পরেও যদি গুজব সৃষ্টি করে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।