নিজস্ব প্রতিবেদক।
বহুল আলোচিত মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ পেয়েছে ৭১ টিভির মালিককানা প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপ।
হাসিনা সরকারের নির্লজ্জ সমর্থক ও অন্যতম সহযোগী গ্রুপটি বর্তমান সরকারকেও বাগে এনে কাজ বাগিয়েছে বল অভিযোগ খোদ মন্ত্রণালয়ের। গত ১৬ বছর আওয়ামী লীগের স্বৈরাচারী দুঃশাসনকে মানুষের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করতে মেঘনা গ্রুপ ব্যবহার করেছে ’৭১ টেলিভিশনকে। আওয়ামী দোসর হিসেবে পরিচিত টেলিভিশন চ্যানেলটি সরকারের অর্থপাচার, লুটপাটকে উন্নয়ন হিসেবে দেখাতে চালিয়েছে নানামুখী অপপ্রচার। সেই সঙ্গে গত ১৫ বছরে নিজেদের সম্পদ বাড়িয়েছে কয়েক হাজারগুন। এই কাজে হরিহর আত্মা হয়ে উঠেছিলেন ৭১ টিভির সাবেক সিও বিতর্কিত সাংবাদিক মোজেম্মল বাবু ও মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তোফা কামাল।
অভিযোগ আছে মেঘনা গ্রুপ গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে নারায়ণগঞ্জে মেঘনা নদীর জমি দখল, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে ছোট সাদিপুরে জমি দখল এবং সোনারগাঁওয়ে আনন্দ গ্রুপের জমি দখলের অভিযোগ আছে। আর তাদেরই কোম্পানি ইউনিক সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রি লি. এবং ভারতের আদিত্য বিরলা কোম্পানির প্রতিষ্ঠান আদিত্য বিরলা গ্লোবাল ট্রেডিং কোম্পানি পিটিই (সিঙ্গাপুর এর রেজিস্ট্রার্ড) এর কনসোর্টিয়ামকে ৩৫ লাখ মেট্রিক টন কয়লা সরবরাহ এর জন্য কার্যাদেশ প্রদান করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ১৭ অক্টোবর প্রতিষ্ঠানটিকে ৩৭০ বিলিয়ন ৫৪৫ হাজার ডলার যা টাকার অঙ্কে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। অভিযোগ উঠেছে, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা সরবরাহের দরপত্র প্রক্রিয়ায় প্রাথমিকভাবে বাতিল হওয়া এই প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই করা হয়নি। নাম প্রকাশে একাধিক ব্যক্তি অভিযোগ করে বলেছেন, এর নেপথ্যে কাজ করেছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। তিনি নিজের কাজ বাদ দিয়ে দেশ ও জাতিকে জ্ঞান দিতে একটি বিশেষ পত্রিকায় কলাম লিখে বেড়াচ্ছেন। অথচ তার দপ্তরে আওয়ামী দোসররা অনিয়মের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ গত ১৪ সেপ্টেম্বর মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিদর্শন করে এটিকে বিলাসী প্রকল্প হিসেবে উল্লেখ করেছেন উপদেষ্টা। তিনি বলেছেন, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পের বরাদ্দ ৩৬ হাজার কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫৭ হাজার কোটি টাকা করেছে বিগত সরকার। অথচ এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে মাত্র এক হাজার ২শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি প্ল্যান্ট করা হয়েছে। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র জনগণের উপকারে আসছে না। এগুলো প্রকল্প বিলাস। এই প্রকল্প বাস্তবায়নকালে মেগা দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগগুলো তদন্ত করা হবে। এই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেও একমাস পার না হতেই গত ১৭ অক্টোবর আওয়ামী দোসর মেঘনা গ্রুপকে কয়লা সরবরাহের কাজ দেয়া হয়। এছাড়া দ্রুত মামলা জট নিষ্পত্তি করে নতুনভাবে টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কয়লা সরবরাহের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ করবেন বলে মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিদর্শনকালে সাংবাদিকদের জানান। অথচ ঘটেছে উল্টো।
সূত্র মতে, এর আগে দরপত্র প্রক্রিয়ায় প্রাথমিকভাবে বাতিল করা হয়েছিল প্রতিষ্ঠানটিকে। কিন্তু আওয়ামী সরকারের উচ্চ মহলের সহযোগিতায় পরবর্তীতে এই সিদ্ধান্ত বহালে আদালতের শরণাপন্ন হয়। পাশাপাশি প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা মেঘনা গ্রুপকে কাজ দিতে তাদের সঙ্গে পৃথকভাবে বৈঠক করে বাস্তবায়নকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির (সিপিজিসিবিএল)। প্রতিষ্ঠানটিকে কিভাবে কাজ দেয়া যায় এর পরিকল্পনা করে। এরপর আওয়ামী দোসরদের সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছেন বর্তমান উপদেষ্টা। প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ বড় অঙ্কের বাণিজ্যের বিনিময়ে আওয়ামী দোসর মেঘনা গ্রুপকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে কয়লা সরবরাহের কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ২০২৩ সালে করা টেন্ডার প্রক্রিয়াকে বাস্তবে রূপ দেন একটি চক্র। পট পরিবর্তনের পর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে কোটেশন আসলেও, সবাইকে উপেক্ষা করে মেঘনা গ্রুপ এর কোম্পানি ইউনিক সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রি লি. এবং ভারতের আদিত্য বিরলা কোম্পানির প্রতিষ্ঠান আদিত্য বিরলা গ্লোবাল ট্রেডিং কোম্পানি পিটিই (সিঙ্গাপুর এর রেজিস্ট্রার্ড) এর কনসোর্টিয়ামকে ৩৫ লাখ মেট্রিক টন কয়লা সরবরাহ এর জন্য কার্যাদেশ প্রদান করে। ভারতীয় কোম্পানির সাথে মেঘনা গ্রুপ এর কনসোর্টিয়ামকে ১০৫ দশমিক ৮৭ টাকা রেটে কার্যাদেশ দেয়া হলেও বর্তমান উপদেষ্টার নিকট ৯৫, ৯৭ ও ৯৯ টাকার বিভিন্ন রেটের কোটেশন জমা ছিল।
একই সঙ্গে মামলা জটিলতার কারণে এবং নির্দিষ্ট এই প্রতিষ্ঠানটিকে কাজ দিতে পূর্ববর্তী হাসিনা সরকার টেন্ডার প্রক্রিয়া স্থগিত রাখে। প্রকল্প কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারিতায় বাতিল হওয়া তিন কনসোর্টিয়ামের একটি গত ২৯ মে বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিবের কাছে দরপত্র পুনঃমূল্যায়নের জন্য আবেদনও করে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার আসার পরে উপদেষ্টা ফয়জুল কবীর দ্রুত মামলা জট নিষ্পত্তি করে নতুনভাবে টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কয়লা সরবরাহ এর জন্য ঠিকাদার নিয়োগ করবেন বলেও বিতর্কিত মেঘনা গ্রুপকেই কাজ পাইয়ে দেন।
দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী, কমপক্ষে ১২ লাখ মেট্রিক টন কয়লা আমদানির অভিজ্ঞতার শর্ত উল্লেখ ছিল, যা কয়লা আমদানি সংশ্লিষ্ট দরপত্রের জন্য একটি প্রাসঙ্গিক শর্ত। কিন্তু একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠানকে অনৈতিক সুবিধা প্রদানের উদ্দেশে উক্ত শর্তটি শিথিল করে ১২ লাখ মেট্রিক টন লোহা, সার, কেমিক্যাল, সিমেন্ট অথবা খাদ্যশস্য আমদানির অভিজ্ঞতাকে যোগ্যতা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা একটি অসম প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করে।
দরপত্রে অংশ নেয়া প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি কনসোর্টিয়ামের আন্তর্জাতিক দরপত্রে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা সরবরাহের অভিজ্ঞতা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, কয়লা সরবরাহে আমাদের ব্যাপক অভিজ্ঞতা ও সাফল্য বিবেচনা না করেই এবং বিস্তারিত কোনো কিছু অবগত না করেই এবং কারিগরি বিষয়ে আমাদের কোনো প্রশ্ন না করে এবং কোনো প্রকার ব্যাখ্যার সুযোগ না দিয়েই আমাদের ‘কারিগরিভাবে অযোগ্য’ ঘোষণা করা হয়।
একটি মাত্র প্রতিষ্ঠানের দরপত্রকে কারিগরিভাবে যোগ্য ঘোষণা করে প্রতিযোগিতামূলক এবং রাষ্ট্রের জন্য লাভজনক না হওয়া সত্ত্বেও একক প্রতিষ্ঠানকে ‘পক্ষপাতিত্বমূলক’ভাবে কার্যাদেশ প্রদানের মাধ্যমে টেন্ডার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে বলে দরপত্রে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো জানায়।
এদিকে ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর মেঘনা গ্রুপের টাকা পাচার নিয়ে গোয়েন্দা সংস্থা এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করলেও, মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ২০২৩ সালে করা টেন্ডার প্রক্রিয়াকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন চক্রটি। মেঘনা গ্রুপকে কার্যাদেশ দেয়ার জন্য বিশাল অংকের আর্থিক লেনদেনও সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত জুলাই এবং আগস্ট বিপ্লবকে ভূলুণ্ঠিত করতে ভারতীয় কোম্পানি এবং টাকা পাচারে সম্পৃক্ত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের দোসর মেঘনা গ্রুপকে এই সুযোগ দেয়া হয়েছে।
মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের সদ্য নিয়োগ পাওয়া ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নাজমুল হক বলেন, এই প্রকল্প নিয়ে অনেক কিছু হয়েছে সবাই জানে। কোর্টের রায়ও পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। আমি মনে করি সবকিছু ঠিক আছে।