আনোয়ার সাঈদ তিতু, কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি:-
পূর্ব প্রান্তে বিশালাকার ব্রহ্মপুত্র, পশ্চিমে ধরলার বিভক্ত প্রবাহ। মাঝখানে দ্বীপ-সদৃশ ভূখণ্ডে কয়েকটি গ্রাম নিয়ে কুড়িগ্রামের উলিপুরের বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের মূল এলাকা। দুই নদীর ভাঙন গ্রাসে সংকুচিত হয়ে আসা দ্বীপগ্রামে কয়েক হাজার পরিবারের বসতি। পাকা আর গ্রামীণ কাঁচা সড়ক ধরে গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে ধরলার তীরে পৌঁছাতেই চোখে পড়ে ধরলার বিধ্বংসী রূপ। বসতভিটা, গাছপালা আর কৃষিজমিসহ পাকা স্থাপনা সবকিছুই গিলছে এ নদী। এ যেন ধরলার অন্য এক রূপ।
ধরলা তীরঘেঁষে থাকা গ্রামের সড়ক, কৃষিজমি এবং ইউনিয়নের একমাত্র মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুদিরকুটি আব্দুল হামিদ উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে পড়ে আছে ভিটাহারা পরিবারগুলোর ভেঙে নেওয়া ঘর ও সরঞ্জামাদি। পাশেই খুদিরকুটি আকেল মামুদ কমিউনিটি ক্লিনিক আর বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রটি নদীতে বিলীন। ভাঙনঝুঁকি থাকলেও নিরুপায় কয়েকটি পরিবার স্কুলভবনে আশ্রয় নিয়েছে। সেখানেই চলছে রান্না ও খাবারের আয়োজন। যেন শরণার্থীশিবির।
নদীতীরে কেউ ঘরবাড়ি ভাঙছেন আবার কেউ-বা গাছপালা কাটায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। ভাঙনের শিকার পরিবারগুলোর সদস্যদের চোখেমুখে সংসার জীবনের নিরুদ্দেশ যাত্রার সংশয়। নারীদের চোখমুখে হতাশা আর ভিটে হারানোর বেদনা মোটা দাগে ফুটে উঠেছে যেন! বাস্তুভিটাহারা এমনই এক নারী শাহিনুর বেগম।
‘ঘর ডাবি (দেবে) যাবার ধরছে। নাও তলে গেইছে। তাড়াহুড়া করি ঘর ভাঙ্গি নিয়া মাইনষের জাগাত থুচি। এলা কোটাই যায়া থাকমো সেটা জানি না।’ ধরলার ভাঙনের তীব্রতায় নিজেদের দুর্দশার কথা এভাবেই বর্ণনা করলেন শাহিনুর।
অনিশ্চিত গন্তব্যে ভবিষ্যৎ জীবনযাত্রার কথা জানিয়ে এই নারী বলেন, ‘স্বামী বাড়িতে মিষ্টি বানায় নিয়া ফেরি করে বিক্রি করে। সেই রোজগারে পরিবার চলে। এখন বাড়িটাই নদীত গেলো। কোটাই থাকমো, কেমন করি জীবন চলবে জানি না।’
শাহিনুরের বিলীন হওয়া বসতভিটার পাশেই ইউনিয়ন চেয়ারম্যান বাবলু মিয়ার বসতি। ধরলা চেয়ারম্যানের বাড়িকেও নিস্তার দেয়নি। চেয়ারম্যান তার বসতভিটা থেকে গাছপালাসহ সকল সরঞ্জাম সরিয়ে নিয়েছেন।
শুধু শাহিনুর কিংবা চেয়ারম্যান নন, স্কুলভবনে আশ্রয় নেওয়া সামিনাসহ (৬৩) কয়েকটি পরিবার, সাবেক ইউপি সদস্য মহুবরসহ অর্ধশতাধিক দিনমজুর পরিবার ধরলার ‘অস্বাভাবিক’ ভাঙনে বাস্তুহারা হয়েছেন। তাদের পরবর্তী আশ্রয়স্থল কোথায়, কীভাবে হবে, তা নিয়ে দিশেহারা। গত পাঁচ দিন আগে শুরু হওয়া ভাঙন বুধবার (২ অক্টোবর) পর্যন্ত চলমান রয়েছে। ধরলার এমন রুদ্ররূপ সচরাচর দেখা যায় না।
নদীভাঙনে কুড়িগ্রামে এমনই নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। জেলার এক প্রান্তে তিস্তা আরেক প্রান্তে ধরলা-ব্রহ্মপুত্রের তীব্র ভাঙনে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন বাসিন্দারা। বসতভিটা আর আবাদি জমি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে একের পর এক পরিবার। ভাঙনের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে স্কুল ও মসজিদসহ কয়েকশ পরিবার।
ধরলার ভাঙনের তীব্রতা প্রসঙ্গে ইউনিয়নের বাসিন্দা মিজানুর রহমান বলেন, ‘ধরলা পাগলামি শুরু করছে। পাগলের মতো তীর ভাঙতেছে। যখন ভাঙা শুরু করে মনে হয় একবারে সব গিলে ফেলে। ধরলা আর ব্রহ্মপুত্র প্রতিবছর ভাঙতে ভাঙতে আমাদের শেষ করি দিলো। ভাঙন রোধে কর্তৃপক্ষ স্থায়ী কোনও ব্যবস্থা নেয় না।’ ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের আল আমিন বাজার থেকে খুদিরকুটি বাজার হয়ে কবিরাজপাড়ার শেষে পর্যন্ত প্রায় ২ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ধরলার ভাঙন চলছে বলে জানান তিনি।
স্থানীয়রা বলছেন, গত ৫ দিনে ধরলার ভাঙনে জেলার উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নে কমপক্ষে ৭০ পরিবারের বসতি ধরলার গর্ভে বিলীন হয়েছে। আমন আবাদসহ প্রায় ২০০ বিঘা আবাদি জমি ধরলার করালগ্রাসে ভূখণ্ড থেকে হারিয়ে গেছে। এলাকাজুড়ে উদ্বাস্তুদের হাহাকার। এলাকাবাসীর অভিযোগ, বাসিন্দাদের অস্তিত্ব সংকটাপন্ন হলেও ভাঙন প্রতিরোধে জোরালো কোনও পদক্ষেপ নেয়নি স্থানীয় প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।
বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের বাসিন্দা ও স্নাতক শিক্ষার্থী আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘তীব্র ভাঙন চললেও পাউবো আলসেমি করছে। ভাঙন রোধে তাদের পদক্ষেপ গতিশীল নয়। এখানে কয়েক হাজার জিও ব্যাগ ফেললে সাময়িকভাবে ভাঙন রোধ সম্ভব। কমপক্ষে স্কুলটি রক্ষা করা যাবে। কিন্তু সেটা না করে উল্টো স্কুলভবন নিলামের পাঁয়তারা করা হচ্ছে।’
চেয়ারম্যান বাবলু মিয়া বলেন, ‘গত পাঁচ দিনে কমপক্ষে ৭০ পরিবার বসতি হারিয়েছে। আমি, আমার স্বজনরা বসতি সরিয়েছি। ভাঙন রোধ করতে না পারলে আরও অনেক পরিবার নিঃস্ব হবে। কয়েকশ জিও ব্যাগ ছাড়া ভাঙন রোধে তেমন কোনও উদ্যোগ নেই।’
উলিপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. আতাউর রহমান বলেন, ‘ভাঙন রোধে পাউবোকে বারবার তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। আমরা স্কুলটি রক্ষায় বেশি নজর দিচ্ছি। যারা বাস্তুহারা হয়েছেন তাদের পুনর্বাসনের প্রয়োজন হলে সরকারিভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
পাউবো কুড়িগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। জরুরিভিত্তিতে আড়াই হাজার জিও ব্যাগ ফেলার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আরও ছয় হাজারের অনুমোদন পাওয়া গেছে।’
স্থানীয়দের অভিযোগের বিষয়ে পাউবো প্রকৌশলী বলেন, ‘টেকসই প্রতিরোধ ব্যবস্থা হলো ব্লকের কাজ। কিন্তু জরুরিভিত্তিতে জিও ব্যাগ ছাড়া উপায় নেই। আমরা চেষ্টা করছি স্কুলটি রক্ষা করার।’
জেলা প্রশাসক নুসরাত সুলতানা বলেন, ‘স্কুল রক্ষায় পাউবো নির্বাহী প্রকৌশলী ও ইউএনওকে নির্দেশনা দিয়েছি।’