বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ০৪:৪৬ অপরাহ্ন

সীতাকুণ্ড শিবচতুর্দশী মেলা: ভক্তির সাগরে হাজার হাজার জনতার ঢল

মো:রমিজ আলী, সীতাকুণ্ড প্রতিনিধি(চট্টগ্রাম)।
  • প্রকাশের সময় : বৃহস্পতিবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫
  • ৩৩ বার পড়া হয়েছে

মো:রমিজ আলী,
সীতাকুণ্ড প্রতিনিধি(চট্টগ্রাম)।

শতাব্দীপ্রাচীন শিবচতুর্দশী মেলা সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ ধামে পরিণত হয়েছে এক মহাপুণ্যতীর্থে। প্রতিবছর ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণ চতুর্দশী তিথিতে অনুষ্ঠিত এই মেলা শুধু ধর্মীয় আচার নয়, বরং এটি এক আবেগঘন উৎসব, যেখানে দেশ-বিদেশ থেকে আসা লাখো ভক্ত ভগবান শিবের চরণে নিবেদন করেন তাঁদের অন্তরের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। পাহাড়ের চূড়া থেকে সমতল ভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত সাড়ে তিন কিলোমিটার জুড়ে ঢল নামে দেশ-বিদেশ থেকে আসা পূণ্যার্থীদের।

নিরাপত্তা ও প্রশাসনের প্রস্তুতি:

সীতাকুণ্ডের এই ঐতিহ্যবাহী মেলাকে ঘিরে ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে প্রশাসন কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক,পুলিশ সুপার,সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও থানার ওসি মেলা কমিটির সঙ্গে প্রস্তুতি সভা করেছেন। পুলিশ সুপার জানিয়েছেন, মেলায় পুলিশ, ডিবি, ডিএসবি সহ ৫০০-রও বেশি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন থাকবেন।

সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. ফকরুল ইসলাম বলেন, “আমি এখানে নতুন যোগ দিয়েছি। তবে বহু আগে থেকেই এই ঐতিহ্যবাহী মেলার কথা জানি। জেলা প্রশাসকের নির্দেশনায় মেলার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য আমরা প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি নিয়েছি।”

সীতাকুণ্ড থানার ওসি মো. মজিবর রহমান বলেন, “প্রতিবছর এই মেলায় কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে চাঁদাবাজি ও ছিনতাই রোধে চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার সকল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে সতর্ক থাকতে বলেছেন। আমরা অপকর্মের কোনো সুযোগ দেব না।”

ভক্ত ও পূর্ণার্থীদের ঢল: উচ্ছ্বাসের এক মহাসমাগম

এই মেলাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার পূর্ণার্থী আসেন শিবের আশীর্বাদ লাভের আশায়। সীতাকুণ্ড মেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মনোজ কুমার নাথ বলেন, “কয়েক শতাব্দী ধরে শিব চতুর্দশী তিথির একদিন আগে থেকে পূণ্যার্থীদের আগমনের মধ্য দিয়ে মেলা শুরু হয়, যা তিন দিনব্যাপী চলে। দেশ-বিদেশের প্রায় ১৫-২০ লাখ ভক্ত এই মেলায় অংশ নেন।”

ভক্তদের মধ্যে ছিল এক অভূতপূর্ব আনন্দ। তারা বলছেন, এখানে আসতে পেরে তারা অত্যন্ত খুশি। কেউ কেউ উপবাস রেখে ব্রত পালন করেছেন, কেউ বা দেশ ও জনগণের কল্যাণের জন্য প্রার্থনা করেছেন। পূজার আয়োজনে নারীরা গঙ্গাজল ছিটিয়ে মঙ্গল কামনা করেন, পুরুষেরা ধূপ-দীপ জ্বালিয়ে মহাদেবের চরণে অর্ঘ্য অর্পণ করেন। এক ভক্ত বলেন, “এখানে এলে আত্মার এক অপার্থিব শান্তি অনুভব করি। মহাদেব যেন আমাদের সকল মনস্কামনা পূরণ করেন, দেশের মঙ্গল করেন।”

শুধু ধর্মীয় আচার নয়, এই মেলা হয়ে ওঠে এক আনন্দময় মিলনমেলা। চারদিকে ধূপের গন্ধ, শঙ্খধ্বনি, আরতি ও শিবের জপে মুখর হয়ে ওঠে পুরো সীতাকুণ্ড। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সকল বয়সের মানুষ, নারী-পুরুষ, শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত শিবের কৃপা লাভের আশায় পাহাড় বেয়ে উপরে ওঠেন। কষ্ট হলেও তাদের মুখে ছিল এক অভূতপূর্ব প্রশান্তির ছাপ।

শোকের ছায়া: পূর্ণার্থীদের মৃত্যু

এবারের মেলায় ভক্তদের ব্যাপক ভিড় ও গরমের কারণে দুঃখজনকভাবে এক দিনে দুইজন পূণ্যার্থী মারা গেছেন। সীতাকুণ্ড ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার সাইদুল ইসলাম জানিয়েছেন, প্রচণ্ড চাপ ও গরমের কারণে স্ট্রোকজনিত কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

নিহতদের মধ্যে একজন পুরুষ, যার নাম বান্টু, পিতা মাগন, বাড়ি চকরিয়া। অপরজন এক অজ্ঞাতনামা মহিলা, যার পরিচয় এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। মরদেহ দুটি পটিয়া থানার মাধ্যমে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ঘটনায় আরও প্রায় ১২ জন ভক্ত অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, যাদের দ্রুত চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।

শিবচতুর্দশীর তাৎপর্য: শিবের আশীর্বাদে সকলের মঙ্গল

শিব চতুর্দশী হল মহাদেব শিবের মহাপ্রলয় তিথি, যেদিন তিনি সর্বশক্তিমান হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন। এই রাতে ভক্তরা উপবাস, জপ, ধ্যান ও পূজা করেন। শিব হলেন ধ্বংস ও সৃষ্টির দেবতা, যিনি পাপ থেকে মুক্তি দিয়ে জীবনে শান্তি ও কল্যাণের বার্তা আনেন।

চন্দ্রনাথ ধামের শিবলিঙ্গ অত্যন্ত প্রাচীন ও সিদ্ধস্থান হিসেবে পরিগণিত। হাজার বছর ধরে ভক্তরা এই স্থানে এসে প্রার্থনা করে থাকেন। তাঁদের বিশ্বাস, এখানে মহাদেবের কৃপায় সকল দুঃখ-কষ্ট লাঘব হয়, মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয় এবং সকল অশুভ শক্তি দূর হয়ে যায়।

উপসংহার:

শিবচতুর্দশী মেলা শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়,এটি ভক্তদের আত্মিক মিলনমেলা। লাখো ভক্তের আগমনে মেলা প্রাঙ্গণ পরিণত হয় এক মহাজাগরণের কেন্দ্রে।প্রশাসনের কঠোর নিরাপত্তা,পূণ্যার্থীদের ভক্তি ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় এই মেলা সফলভাবে সম্পন্ন হচ্ছে।

যদিও কিছু দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে, তবু শিবের আশীর্বাদে ও প্রশাসনের তৎপরতায় এই মহোৎসব শান্তিপূর্ণভাবে উদযাপিত হচ্ছে। ভক্তদের বিশ্বাস,মহাদেবের কৃপায় আগামী দিনগুলোতেও এই মেলা একই উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে পালিত হবে, এবং সমগ্র জাতি তাঁর আশীর্বাদে কল্যাণ লাভ করবে।

সংবাদ টি শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ